জীবনের নানা বৈচিত্রের শ্রেণীবিভাগ | ট্যাক্সোনমি এবং ট্যাক্সোনমিক হায়ারার্কি
১. ট্যাক্সোনমি বা বিন্যাসবিধি কাকে বলে?
উত্তরঃ- জীববিদ্যার যে শাখায় জীবের পারস্পরিক সাদৃশ্য ভিত্তিতে তাদের শনাক্তকরণ, নামকরণ ও শ্রেণিভুক্তকরণের এবং আইনকানুন বিজ্ঞানসম্মতভাবে আলােচনা করা হয় ট্যাক্সোনমি বা বিন্যাসবিধি বলা হয়।
২. ট্যাক্সোনমি শব্দটির উৎপত্তি কীভাবে হয়েছে?
উত্তরঃ- ট্যাক্সোনমি (Taxonomy) শব্দটি দুটি গ্রিক শব্দ থেকে উৎপত্তি লাভ করেছে। যথা- (i) ট্যাক্সিস (Taxis) কথার অর্থ হল arrangement বা বিন্যাস এবং (i) নােমােস (Nomos) কথার অর্থ হল law বা বিধি বা নিয়ম। অর্থাৎ ট্যাক্সোনমির বুৎপত্তিগত অর্থ হল বিন্যাসবিধি।
৩. কোন্ বিজ্ঞানী কত সালে ট্যাক্সোনমি’ শব্দটি প্রবর্তন করেন?
উত্তরঃ- সুইডিশ বিজ্ঞানী পি দ্য ক্যানডােলে (P de Candolle) 1813 সালে তার প্রকাশিত ‘Theorie elementerie de la Botanique’ গ্রন্থে প্রথম ‘ট্যাক্সোনমি’ (Taxonomy) শব্দটি প্রবর্তন করেন।
৪. সিস্টেমেটিক্স (Systematics) কাকে বলে?
উত্তরঃ- বিজ্ঞানী সিম্পসন (Simpson, 1960)-এর মতে, (, জীবের প্রকারভেদ, বৈচিত্র্য এবং তাদের পারস্পরিক তুলনামূলক ও বিবর্তনগত সম্পর্ক নির্ধারণ করার বিজ্ঞানকে সিস্টেমেটিক্স (Systematics) বলে।
৫. শ্রেণিবিন্যাস (Classification) কাকে বলে?
উত্তরঃ- জীবের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য এবং পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তিতে জীবজগৎকে সুশৃঙ্খল রীতিনীতি অনুযায়ী গােষ্ঠীভুক্তকরণকেই বলা হয় শ্রেণিবিন্যাস।
৬. ট্যাক্সোনমির জনক কাকে বলে? তাঁর লিখিত গ্রন্থটির নাম লেখাে?
উত্তরঃ- ট্যাক্সোনমির জনক (Father of Taxonomy) হলেন ক্যারােলাস লিনিয়াস (Carolus Linnaeus; 1707-1778)। তারলিখিত গ্রন্থ হল-(i) স্পিসিস প্ল্যান্টেরাম (Species Plantarurn) এবং (ii) সিস্টেম ন্যাচুরি (Systema Naturae)।
৭. ট্যাক্সোনমি বা বিন্যাসবিধির প্রধান উপাদানগুলি কী কী?
উত্তরঃ- ট্যাক্সোনমির বা বিন্যাসবিধির প্রধান উপাদানগুলি হল(i) বৈশিষ্ট্য নির্বাচন, (ii) শনাক্তকরণ, (i) নামকরণ, (iv) শ্রেণিবিন্যাস, (v) প্রামাণ্য দলিল সংরক্ষণ।
৮. শনাক্তকরণ (Identification) কাকে বলে?
উত্তরঃ- বিশেষ বৈশিষ্ট্যর ওপর ভিত্তি করে কোনাে জীবকে অন্যান্য জীবদের থেকে আলাদা করে চিনে নেওয়ার পদ্ধতিকে বলা হয় শনাক্তকরণ। এটি ট্যাক্সোনমির একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
৯. নামকরণ (Nomenclature) কাকে বলে?
উত্তরঃ- যে পদ্ধতিতে আন্তর্জাতিক স্বীকৃত নিয়ম অনুযায়ী জীবগােষ্ঠীর প্রতিটি জীবকে সঠিক নাম দেওয়ার মাধ্যমে জীবগুলি আলাদাভাবে চিনে নেওয়া হয়, তাকে নামকরণ বলে।
১০. প্রামাণ্য দলিল সংরক্ষণ বলতে কী বােঝাে?
উত্তরঃ- যে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে উদ্ভিদ বা প্রাণীর নমুনা সংগ্রহ করে সংগ্রহশালা বা জাদুঘরে ভবিষ্যতের জন্য সংরক্ষণ করা হয়, তাকে প্রামাণ্য দলিল সংরক্ষণ বলে। প্রামাণ্য দলিল সংরক্ষণ ভবিষ্যতে কোনাে উদ্ভিদ বা প্রাণীর শনাক্তকরণ, নামকরণ বা শ্রেণিবিন্যাস করতে সাহায্য করে।
১১. ট্যাক্সন (Taxon) কাকে বলে?
উত্তরঃ- ট্যাক্সোনমিক ক্যাটেগরিকে যেনির্দিষ্টজীব বা জীবগােষ্ঠীদ্বারা প্রকাশ করা হয়, তাকে ট্যাক্সন বলে। অর্থাৎ ট্যাক্সন হল বিন্যাসবিধির এক একটি গােষ্ঠী যাকে নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যের ওপর ভিত্তি করে নির্দিষ্ট নাম ও নির্দিষ্ট স্তর প্রদান করা হয়। যেমন- রাজ্য-অ্যানিম্যালিয়া, পর্ব কর্ডাটা, শ্রেণি- ম্যামালিয়া। এক্ষেত্রে অ্যানিম্যালিয়া, কর্ডাটা, ম্যামালিয়া এগুলি হল এক-একটি ট্যাক্সন।
১২. ক্যাটেগরি (Category) বলতে কী বােঝায়?
উত্তরঃ- জীবজগতে শ্রেণিবিন্যাসের প্রতিটি একককে বলে ক্যাটেগরি। ক্যাটেগরি শ্রেণিবিন্যাসের ব্যাংক বা লেভেল-কে নির্দেশ করে। যেমন প্রজাতি — শ্রেণি → রাজ্য।
অর্থাৎ, ট্যাক্সন ও ক্যাটেগরির মধ্যে সম্পর্ক হল ট্যাক্সন : কুকুর স্তন্যপায়ী →
ক্যাটেগরি : প্রজাতি শ্রেণি — রাজ্য
এক্ষেত্রে, কুকুর স্তন্যপায়ী এবং প্রাণী হল বাস্তব জীবগােষ্ঠী এবং প্রজাতি (Species), শ্রেণি (Class) এবং রাজ্য (Animal Kingdom) হল হায়ারার্কিয়াল ব্যাংক বা লেভেল।
১৩. ট্যাক্সোনমিক হায়ারার্কির প্রয়ােজনীয়তা কী?
উত্তরঃ- ট্যাক্সনিক হায়ারার্কির প্রয়াজনীয়তা বা গুরুত্ব 0 সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্যের ভিত্তিতে জীবদের গােষ্ঠীভুক্তকরণ ও যথাযথভাবে উপস্থাপনা করা। গু নির্দিষ্ট জীব সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা লাভ। ও জীবের বিবর্তনগত ইতিহাস সম্পর্কে তথ্য পাওয়া সম্ভব হয়।
১৪. রাজ্য বা জগৎ কাকে বলে?
উত্তরঃ- অনেকগুলি বিভাগ বা পর্বের সমন্বয়ে গঠিত শ্রেণিবিন্যাসের সর্ববৃহৎ একক বা গােষ্ঠীকে রাজ্য বা জগৎ বলে। এটি হায়ারার্কির সর্বোচ্চ স্তর। যেমন— উদ্ভিদরাজ্য, প্রাণীরাজ্য, রাজ্য—প্রােটিস্টা, রাজ্য—মনেরা, রাজ্য—ফাংগি প্রভৃতি। আমগাছ উদ্ভিদরাজ্যও মানুষ প্রাণীরাজ্য অন্তর্গত।
১৫. বিভাগ বা পর্ব কাকে বলে?
উত্তরঃ- এক বা একাধিক সম্পর্কযুক্ত শ্রেণি মিলিতভাবে হায়ারার্কির যে অপেক্ষাকৃত বৃহৎ ক্যাটেগরি বা র্যাংক বা একক গঠন করে, তাকে বিভাগ (উদ্ভিদের ক্ষেত্রে) বা পর্ব (প্রাণীদের ক্ষেত্রে) বলে। যেমন— আমগাছ অ্যানজিওস্পার্মি বা গুপ্তবীজী বিভাগের এবং মানুষ কর্ডাটা পর্বের অন্তর্গত।
১৬. শ্রেণি (Class) কাকে বলে?
উত্তরঃ- কতকগুলি সাদৃশ্য বৈশিষ্ট্যযুক্ত বর্গ-এর সমন্বয়ে গঠিত গােষ্ঠীকে বলা হয় শ্রেণি (Class)। যেমন—আমগাছ ডাইকটিলিডােনি এবং মানুষ ম্যামালিয়া বা স্তন্যপায়ী শ্রেণির অন্তর্গত।
১৭. বর্গ (Order) কাকে বলে?
উত্তরঃ- পরস্পর সম্পর্ক ও সাদৃশ্যযুক্ত কতকগুলি গােত্রের সমন্বয়ে হায়ারার্কির যে বৃহৎ একক গঠিত হয় তাকে বর্গ বলে। যেমনআমগাছের বর্গ হল স্যাপিনডালিস এবং মানুষের বর্গ হল প্রাইমেট।
১৮. গােত্র (Family) কাকে বলে ?
উত্তরঃ- উৎপত্তিগতভাবে ঘনিষ্ঠ, জননাঙ্গ সংক্রান্ত সাদৃশ্যযুক্ত এক বা একাধিক গণের সমসিকে গোত্র বা ফ্যামিলি বলে। যেমনআমগাছের গােত্র অনাকার্ভিয়েসি এবং মানুষের গাে এ হল হােমিনিডি।
১৯. গণ (Genuis) কাকে বলে?
উত্তরঃ- একই পূর্বপুরুষ থেকে উদ্ভূত এক বা একাধিক সম্পর্ক বদ্ধ প্রজাতির সমষ্টিকে বলা হয় গণ । যেমন যেমন আম গাছের গণ মঙ্গিফেরা (Mangifera) এবং মানুষের গণ হলো হোমো (Homo) ।
২০. প্রজাতি বলতে কী বােঝাে ?
উত্তরঃ- বিজ্ঞানী মেয়র (Mayr, 1966) -এর মতে প্রজাতি হল একটি দ্রতম প্রাকৃতিক জীবগোষ্ঠী, যারা নিজেদের মধ্যে প্রজননেসক্ষম হলেও অন্য জীবগােষ্ঠী থেকে জননগতভাবে বিচ্ছিন্ন থাকে এবং স্বতন্ত্রভাবে বসবাস করে। যেমন—আমগাছের প্রজাতি হল ইন্ডিকা (indica) এবং মানুষের প্রজাতি হল স্যাপিয়েন্স (sapiens)।
২১. শ্রেণিবিন্যাসের ভিত্তিগুলি কী কী?
উত্তরঃ- শ্রেণিবিন্যাসের কয়েকটি মূল ভিত্তি হল :
1. অঙ্গসংস্থানজনিত ভিত্তি;
2. ণতত্ত্বগত ভিত্তি;
3. বাস্তুবিজ্ঞানজনিত ভিত্তি;
4.কোশগত ভিত্তি;
5.জৈব-রসায়নজনিত ভিত্তি;
6. পরাগরেণুর ভিত্তি।
২২. বৈজ্ঞানিক নাম ল্যাটিনে লেখা হয় কেন?
উত্তরঃ- বিজ্ঞানী লিনিয়াস জীবের বিজ্ঞানসম্মত নামকরণ শুরু করেছিলেন ল্যাটিন ভাষা ব্যবহার করে। ল্যাটিন ছিল সেই সময়কার বহুল প্রচলিত ভাষা। বিভিন্ন উদ্ভিদ ও প্রাণীর ভাষাভেদে ও স্থানভেদে নাম বদলে যায়। তাই প্রত্যেকটি জীবের একটি সর্বজন গৃহীত (unirversal) অভিন্ন নাম হওয়া প্রয়ােজন। সেইজন্য বর্তমানে ল্যাটিন একটি মৃত ভাষা (dead language) হলেও বিজ্ঞানসম্মত নাম ল্যাটিনে লেখা হয়।
২৩. জীবের পাঁচরাজ্য শ্রেণিবিন্যাস কে করেন? পাঁচ রাজ্য শ্রেণিবিন্যাসের ভিত্তিগুলি কী কী?
উত্তরঃ- বিজ্ঞানী হােয়াইটেকার (1969) জীবের পাঁচরাজ্যশ্রেণিবিন্যাস করেন।
পাঁচরাজ্য শ্রেণিবিন্যাসের ভিত্তিঃ দেহগঠনের জটিলতা, পুষ্টি পদ্ধতি, বাস্তুতান্ত্রিক ভূমিকা, জাতিজনিগত সম্পর্ক,|এবং কোশের গঠন।
২৪. মনেরা রাজ্যের অন্তর্গত জীবদের আদি প্রকৃতির জীব বলা হয় কেন?
উত্তরঃ- মােনেরা রাজ্যের অন্তর্গত জীবদের আদি প্রকৃতির জীব লার কারণ— জীব এককোশী এবং প্রােক্যারিওটিক প্রকৃতির।
ও কোশে সুগঠিত নিউক্লিয়াস ও পর্দাবৃত কোশীয় অঙ্গাণু থাকে না।
দ্বিতন্ত্রী চক্রাকার DNA নগ্ন প্রকৃতির অর্থাৎ প্রােটিনবিহীন।
২৫. শৈবাল ও ছত্রাকের দুটি সাদৃশ্য ও একটি বৈসাদৃশ্য উল্লেখ করাে?
উত্তরঃ- শৈবাল ও ছত্রাকের সাদৃশ্য : শৈবাল ও ছত্রাক উভয়েই কোশপ্রাচীরযুক্ত।শৈবাল ও ছত্রাক উভয়েই সমাঙ্গদেহী অর্থাৎ দেহ মূল, কাণ্ড, পাতায় বিভেদিত থাকে না।
শৈবাল ও ছত্রাকের বৈসাদৃশ্য : শৈবাল ক্লোরােফিলযুক্ত এবং ভাজী। অন্যদিকে ছত্রাক ক্লোরােফিলবিহীন ও মৃতজীবী।
২৬. শৈবাল ও মসজাতীয় উদ্ভিদগুলির সাদৃশ্যগুলি উল্লেখ করাে ?
উত্তরঃ- শৈবাল ও মসজাতীয় উদ্ভিদগুলির সাদৃশ্যগুলি হল— শৈবাল ও মস উভয়ই স্বভােজী প্রকৃতির উদ্ভিদ।
- উভয়েরই দেহ মূল ও কাণ্ডে বিভক্ত থাকে না।
- শৈবাল ও মস উভয়েরই দেহে ক্লোরােফিল থাকে।
- এদের প্রধান উদ্ভিদদেহ লিঙ্গধর হয়।
- ও এদের উভয়েরই দেহে সংবহন কলাতন্ত্র থাকে না।
২৭. ব্রায়ােফাইটা সর্বত্র জন্মাতে পারে কেন?
উত্তরঃ- ব্রায়ােফাইটা সর্বত্র জন্মাতে পারে কারণ— এরা নির্দিষ্ট মূল বা মূলতন্ত্রের অধিকারী না হওয়ায় যে-কোনাে জলীয় পরিবেশ থেকে সরাসরি জল শােষণ করতে পারে। এদের শুক্রাণু দ্বি-ফ্ল্যাজেলাযুক্ত যা সহজেই জলের মাধ্যমে বাহিত হয়ে স্ত্রীধানীতে পৌছায়।